COVID-19, অর্থাৎ নভেল করোনাভাইরাসের সঙ্গে সঙ্গে তার আতঙ্কও আমাদের সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত।
ফেসবুক, হোয়াটসআপ ছেয়ে যাচ্ছে কতরকম খবরে- তার কতকটা সত্যি, কতকটা মিথ্যে, আর কতকটা শুধুই বিভ্রান্তির কারণ।
এসব খবরের সত্যতা যাচাই করে নেওয়াও ভারি মুস্কিল। এরই মাঝে আমার সহযোগী গবেষক বন্ধু সৌমিক ভট্টাচার্য একটা চমৎকার পোস্ট
পাঠালো। আমি আর সৌমিক গত বছরখানেক ধরে একজন মানুষের থেকে অনেকের মধ্যে ভাইরাস কিভাবে ছড়ায়, কিভাবে হু হু করে অসুস্থ মানুষের সংখ্যা বাড়ে আর কিভাবেই বা তাকে থামানো যায়, তার ওপর কিছু কাজ করছিলাম।
পোস্ট’টি দেখামাত্র মনে হল, আমরা কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা চালাতেই পারি, যাতে দ্রুত সমাধানের একটা পথ পাওয়া যেতে পারে। ভারতবর্ষের মত দেশে অবস্থা’টা এখন ঠিক কি রকম, আর যেসব ব্যবস্থা আমরা নিচ্ছি, তাতে সমস্যা সমধানের সম্ভাবনাই বা কতটা, সেটা আন্দাজে হয়তঃ আমরা অনেকেই বুঝতে পারছি। কিন্তু, একটা ছবির (বা ভিডিও-র) সাহায্যে যা বোঝানো যায়, একশ’টা কথায় হয়তঃ তা যায় না। তাই অনেক সহজে আর অনেক স্পষ্ট করে ব্যাপার’টার গুরুত্ব বোঝাতে আমরা এই উদ্যোগ নিলাম।
আশা করি, অনেক বেশী সংখ্যক মানুষ, এমনকি আমাদের বাড়ির ছ’বছরের ছোট্ট মানুষটিও এখান থেকে সমস্যা’টির গুরুত্ব বুঝতে পারবে।
আমাদের পরীক্ষাটিকে বুঝে নিতে আসুন, কতগুলো জিনিস প্রথমে ধরে নিই। ধরা যাক, একটি শহরে (অথবা, আপনি ধরে নিতে পারেন গোটা পৃথিবী’তে) দু’ধরনের মানুষ আছে, সুস্থ আর অসুস্থ। একজন সুস্থ মানুষ অসুস্থ কারো সংস্পর্শে এলেই তার অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। এভাবে একজন থেকে দু’জন, দু’জন থেকে চারজন অসুস্থ মানুষ তৈরি হওয়া সম্ভব।
এখন যদি রোগ’টি সাঙ্ঘাতিক রকমের সংক্রামক হয় (ঠিক COVID-19 এর মতন), তাহলে এই সম্ভাবনা বদলে যেতে থাকে নিশ্চয়তায়; অর্থাৎ অসুস্থ মানুষের সংস্পর্শে এলে সুস্থ মানুষ’টি অসুস্থ হবেন’ই, এটা অঙ্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যেতে পারে। তবে, অসুস্থ মানুষ রোগমুক্ত হয়ে উঠবেন কিছুদিনের মধ্যে। রোগের ওপর নির্ভর করে সেই সময়টা খুব কম বা খুব বেশিও হতে পারে। রোগমুক্ত হয়ে ওঠার পর তার ফের অসুস্থ হওয়ার কোন সম্ভাবনা আছে কিনা সেটাও রোগের ওপর নির্ভর করে।
সে ক্ষেত্রে সমস্যা আরো গুরুতর হয়ে উঠতে পারে। আপাততঃ করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে যেটুকু জানা গেছে, দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও তা খুব কম। এই ব্যাপারগুলো মাথায় রেখে যেকোনো ছোঁয়াচে রোগ কিভাবে একটা শহরে, বা একটা দেশে ছড়াবে, তা রোগের ধরনের ওপর নির্ভর করে আমরা অঙ্কের আর কম্পিউটাররে সাহায্যে বুঝে নিতে পারি।
কিভাবে? তারজন্যে চলুন, একটি শহর ধরা যাক, যেখানে এই দু’ধরনের মানুষ বাস করছে। নীল মানুষেরা সুস্থ আর লাল মানুষেরা অসুস্থ।
খানিক বাদে, বাঁ’দিকের ভিডিও’তে কিছু গোলাপি বল দেখতে পাচ্ছেন? এরা হল তারা, যাদের রোগমুক্তি হয়ে গেছে; এরা অসুস্থ হওয়ার নির্দিষ্ট সময় পরে সেরে উঠেছেন ভাইরাসের আক্রমন কাটিয়ে।
আমাদের এই খেলনা-শহরে সবাই নিজের মত যেকোন দিকে যেতে পারে, কোন বাধানিষেধ কেউ মানে না। নীল (সুস্থ) মানুষদের যেই লাল (অসুস্থ) মানুষের সাথে দেখা হয়, তক্ষুনি, প্রায় অবধারিতভাবে নীল মানুষের রঙ বদলে যায় লালে।
অসুস্থ লাল বলের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
এখানে দেখালাম সরাসরি দেখা হওয়া (অর্থাৎ, বলের সাথে বলে সরাসরি ধাক্কা)। প্রত্যক্ষ সংক্রমণ। যেভাবে HIV বা Herpes ছড়ায়। কিন্তু COVID-19 মানুষের শরীরের বাইরেও অন্ততঃ কিছুটা সময় বেঁচে থাকতে পারে, এমনটাই এখনো অব্দি দেখা গেছে ।
ফলে, সরাসরি দেখা না হলেও, অসুস্থ মানুষ’টি অজান্তেই যেখানে ভাইরাস ছড়িয়ে গেছেন, সেখানে ভাইরাস বেঁচে থাকাকালীন হাত দিলে, সেই হাত মুখে-চোখে দিলে, সংক্রমণের সম্ভাবনা তৈরী হবে। একে বলি পরোক্ষ সংক্রমণ।
ওপরের বাঁদিকের ভিডিও’টা দেখুন। প্রতিটি লাল বলের সাথে যোগ হয়েছে একটা ‘প্রভা’। এই লাল প্রভা আসলে অসুস্থ মানুষের চলার পথে ছড়িয়ে যাওয়া ভাইরাস’কে বোঝাচ্ছে। সুস্থ মানুষের সাথে অসুথ মানুষের সরাসরি দেখা না হলেও ওই ভাইরাস-প্রভা পরোক্ষ সংক্রমণ ঘটাতে পারে।
আমাদের ছোট্ট খেলনা-শহরে অল্প মানুষের বাস; তাই হয়তঃ পরোক্ষ সংক্রমণের বাড়তি বিপদ বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু যদি শহরের লোকসংখ্যা বাড়িয়ে দিই, তাহলে?
এবার কিন্তু পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, যে মানুষের সংখ্যা বাড়ানোর সাথে সাথে পরোক্ষ সংক্রমণ কি সাঙ্ঘাতিক রূপ নিতে পারে! এর থেকে কি সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে? সিদ্ধান্ত হল প্রত্যেক’কে সতর্ক থাকতে হবে যাতে এভাবে সংক্রামিত না হয়ে পড়েন। যেখানে ভিড়, বা যেসব জায়গায় জনবসতির ঘনত্ব বেশি, সেখানে সাবধানতাও হয়তঃ যথেষ্ট না।
সেক্ষেত্রে যেকোনো মানুষের সমাবেশ এড়িয়ে চলা দরকার।
আরো একটু পরীক্ষা করে দেখা যাক, যদি এছাড়া আর কোনো উপায় মেলে। যে অসুস্থ তাকে খুঁজে বের করে সরিয়ে রাখা (কোয়ারেন্টাইন করা), কারো কাছাকাছি আসতে না দেওয়া যে কাজে দেবেই, সে তো এই খেলনা-শহরে মানুষের যাতায়াত দেখলেই বোঝা যাচ্ছে।
কিন্তু যেসব দেশের জনসংখ্যা অনেক বেশী, সেখানে এই কাজ শুধু কঠিন না, হয়তঃ করোনা-সন্দেহের সব মানুষ’কে পরীক্ষা করে ওঠা কিছুটা অসম্ভবও। অনেকে হয়তঃ বলবেন, যদি প্রতিটি মানুষ পরস্পরের মধ্যে খানিক’টা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখে? তাহলে? সেই পরীক্ষাও করে দেখলাম আমরা।
সঙ্গে এটাও ধরে নিতেই হল যে, বাস্তবে সবসময় এই নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব না- ভিড়ে, যাতায়াতের পথে মাঝেমধ্যে ধাক্কা লাগতেই পারে।
আমরা আশা করেছিলাম, এতে খুব ভাল ফল পাওয়া যাবে। কিন্তু, কার্যক্ষেত্রে তা মোটেও হল না। কারন’টাও আমরা বুঝতে পারলাম একটু লক্ষ্য করতেই। ধাক্কা এড়ালে, ছোঁয়া এড়ালে আমরা প্রত্যক্ষ সংক্রমণ’কে কাটিয়ে উঠছি, কিন্তু পরোক্ষ সংক্রমণ আমাদের জন্যে অপেক্ষা করে থাকতেই পারে আপাত নিরাপদ ক্যাবের সিটে, বা বাসের হাতলে।
ফলে, মানুষের থেকে এক মিটার দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করলেও সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, চোখে-মুখে হাত না দেওয়া এগুলো মেনে চলা’কে গুরুত্ব দিন বেশী।
অনেক রকম পরীক্ষা করার পর, আমরা দেখলাম যে সবচেয়ে ভালো উপায় কিন্তু যাতায়াত কমানো। ভিডিও দেখলেই বুঝতে পারবেন, যদি বলগুলি আস্তে আস্তে এগোয়, থেমে থাকে আর সাথে সাথে ভিড়/প্রত্যক্ষ সংক্রমণ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে, এক ধাক্কায় ভাইরাস ছড়ানোর হার কমে যায় অনেক’টা। পরোক্ষ সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচানোর ফলেই যাতায়াত কমানো হয়ে উঠলো সেরা উপায়।
তাহলে, খেলনা-শহরের মানুষ’দের দিয়ে নানান পরীক্ষা করে আমরা কি বুঝলাম? প্রথমতঃ, আসুন যাতায়াত কমানোর চেষ্টা করি। যদি যাতায়াত করতে বাধ্য হই, সাবধানে সতর্কতামূলক ব্যবস্থাগুলো নিয়ে তবেই এগোবো, ভিড় এড়িয়ে চলবো। অসুস্থ হলে ভয় না পেয়ে আসুন সাহসী হই, গোপন না করে সকলকে জানাই অসুস্থতার কথা।
ডাক্তারবাবু কবে আপনার জন্যে ব্যবস্থা নেবেন সে অপেক্ষা না করে, আসুন, আশেপাশের সকলের কথা ভেবে নিজেরাই নিজেদের ক’দিন ঘরবন্দি রাখি। অসুখ যদি নাও করে থাকে, ক’দিন একটু ঘরবন্দি থাকতে দোষ কি? এতে শুধু আপনার না, আরো অনেকের উপকার হবে। আপনার ক্ষেত্রে ভাইরাস হয়তঃ সাঙ্ঘাতিক নয়, কিন্তু অন্য কারো ক্ষেত্রে হতে পারে।
আর সবশেষে বলি, মনে রাখবেন, চারিদিকে করোনা সংক্রান্ত মিথ্যে কথা আর অবৈজ্ঞানিক দাবীর ছড়াছড়ি; বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন ভাইরাসের সাথে সাথে এই মিথ্যেগুলোর সাথেও লড়ার। এই ভাইরাস নতুন, তাই নিত্যদিন তার ব্যাপারে নতুন তথ্য সামনে আসছে; সেই অনুযায়ী বদলে যাচ্ছে স্বাস্থ্য-নির্দেশিকা। যেমন, কিছু পরীক্ষা করে বৈজ্ঞানিক’রা মনে করছেন যে, খুব সামান্য মাত্রায় এই ভাইরাস হয়তঃ বায়ুবাহিত হতেও পারে।
সেক্ষেত্রে আমাদের ছবি কিভাবে পাল্টাবে?
ওপরের বাঁ-দিকের ভিডিও’তে বয়েছে শুধুমাত্র প্রত্যক্ষ সংক্রমণ। মাঝের আর ডানদিকের ভিডিও’তে অসুস্থ লাল বলগুলিকে আকারে বাড়িয়ে দিয়ে আমরা আশেপাশের হাওয়া আর চলার পথে ভাইরাসের সামান্য বায়ুবাহিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ার ছবি’টাকে ধরতে চেয়েছি। লাল বলগুলি আকারে কত’টা বাড়বে তা নির্ভর করবে ভাইরাসের ধরণ, তার বেঁচে থাকার ক্ষমতা ইত্যাদির ওপর।
বাড়তি কিছু তথ্য
প্রথমতঃ, এখানে আমরা ধরে নিয়েছি, যে রোগের ছড়ানোর হারের তুলনায় রোগমুক্ত হওয়ার সময় অনেক’টা বেশী। দ্বিতীয়তঃ, এখানে আমরা কোনো মৃত্যুর সম্ভাবনা ধরিনি, যাতে পড়তে গিয়ে আপনি অযথা ভয় না পান। COVID-19 এর ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার সত্যিই খুব কম (হয়তঃ শতকরা ১-২ ভাগ), কিন্তু তাই বলে অবহেলা করবেন না, বয়স্ক মানুষ’দের ওপর কিন্তু এই রোগ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মরণকামড় বসাচ্ছে। তাই অযাচিত সঙ্কট এড়াতে সতর্কতা নিন, নিয়ম মেনে চলুন।
ভালো থাকুন, সাবধানে থাকুন আর আসুন, ক’দিনের জন্য নিজের কাজের আর লাভের গন্ডির বাইরে সকলের জন্যে একটু ভাবি।~ ~ সায়ংতরী